শ্রাবণের যৌবন এখন। ঝুম বৃষ্টি, শুন্য রাস্তা, গলিপথ। বিদ্যুতের তারে বসা কাকগুলোও ভিজে ক্লান্ত। আশে পাশের টিনের চাল, ছাদের পানি পড়ছে পাইপ বেয়ে। সে আওয়াজ বৃষ্টির তীব্রতা যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। মসজিদের ছাদের পানি পড়ছে একটা তিন ইঞ্চি পাইপ বেয়ে। মসজিদের সীমানা প্রাচীরের বাইরে দক্ষিণ পাশে একটা মেস। সরু গলিপথ পেড়িয়ে যেতে হয়। মেসটাতে অনেকগুলো পুরুষ মানুষ থাকে। এদের কেউ কারখানার শ্রমিক। কেউ কলেজ-মাদরাসার ছাত্র। সবাই একই সময়ে মেসে থাকেন না। শুধু রাতের বেলায় সবাই ফেরেন। উপস্থিত তাদেরই দু-এক জনের মধ্যে একটা চাপা ভয়। একটু উৎকন্ঠা। একটা ঘরের সামনে লাশ পড়ে আছে। এই মেসেরই ভাড়াটে। কোন আহাজারী নেই। কান্নাও নেই থেমে থেমে। মসজিদের পাইপ বেয়ে পড়া পানিতে ভিজছে এক যুবক। মেস, উৎকন্ঠিত মানুষ কিছুই তাকে ষ্পর্শ করছে না। সে যেন মসজিদের ছাদের পানিতে পবিত্র হতে চাইছে। অল্প একটু দূরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে চকচকে একটা ছুরি নিয়ে।
সকালঃ ১০টা...
গলির শেষ মাথায় শেষ রুমটার নম্বর এক। দু নম্বর রুমটায় ভাড়াটে মনির, নতুন। এখনো সবার সাথে পরিচয় হয় নি। দেখে শুনে লেখাপড়া জানা ভদ্র মানুষই লাগে। ভোর থেকেই নিচের ক্লাসের ছাত্র পড়ায়। একবারে আট দশজন আসে। সকাল থেকেই আজ ঝির ঝির বৃষ্টি। আজ কেউ ই আসে নি। তাই আপাতত মনিরের হাতে কোন কাজ নেই। ঘরের দরজা বন্ধ। দুটো যুবক এসে দরজা ধাক্কা দেয়। ভেতরে ফিসফিসানির শব্দ। সে শব্দ বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যায়। যুবক দুটো আরো জোড়ে দরজায় ধাক্কা দেয়। চার নম্বর রুমের ভেতর থেকে কথার আওয়াজ আসে। “ঐ হালারপুতে আইজকা আবার দরজা বন্ধ রাখসে ক্যান? সকাল বেলায়ই কত্তগুলান ভেড়া আসে। ভ্যা ভ্যা আওয়াজে ঘুমাইতেও পারি না।” যুবকরা সে কথা শোনে। একজন গিয়ে সে ঘরের বাইরে দরজায় শেকল চড়িয়ে দেয়। আবারও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ। মনির দরজা খুলে দেয়। একজন যুবক ঘরে ঢোকে। অন্যজন গলির প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরে ঢোকা যুবক বাইরে আসে। মনিরকে বুকে জাপটে ধরে সে। ডান হাতে চকচকে ধারালো ছুরি। বা-হাতে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে। ছুরিটা পেটে ঢুকিয়ে দেয়। মনির চিৎকার করে। বাঁচতে, বাঁচাতে আন্দোলিত হয় তার চিৎকার। বাইরে বৃষ্টির তেজ বাড়ে। বাজ পড়ে পর পর কয়েকটা। যুবক এখনো মনিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। জবাই করা মুরগীর মতো মনিরের দেহ। একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে ঝটকা দেয়। শ্বাস বড় হয়। ছোট হয়। কাটা জায়গার চামড়া, মাংশে খিচুনী হয়। যুবক কাতরানো মুরগীর কষ্ট মাখে শরীরে। একটু পরে মনিরকে ছেড়ে দেয়। অলস দেহটা দাঁড়াতে পারে না। নিথর হয়ে পড়ে যায়। খিঁচতে থাকা মাংসল দেহ জানান দেয় প্রাণ ছিল এ দেহে। প্রবেশ পথে থাকা যুবক চার নম্বর রুমের শেকল খুলে দেয়। “দাওতো ছুরিটা আমাকে দাও”। সে ছুরিটা নিজের কাছে নেয়। খুনি যুবকের হাত ধরে বলে “চল এবার”। ওরা বেরিয়ে যায়।
সকালঃ ৯টা ৪৫মিনিট...
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি হয় সাদা সিধে। ঝুপ করে নেমে গেলো। সাধারণত বজ্রের খুব বেশি আনাগোনা থাকে না। আজ সকাল থেকেই বাজ পড়ছে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীও কম এসেছে। হাজিরা ডেকেই সিদ্ধান্ত হলো। স্কুল ছুটি। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। উপস্থিতি খুব কম। বৃষ্টির ফলে অকাল ছুটির উচ্ছাস তাই শোনা যাচ্ছে না। ফাহিম থ্রিতে পড়ে। সবাই জানে ও একটু বোকা সোকা। স্বাস্থ্য ভালো। একটু হেলেদুলেই সবার শেষে বেরোয়। গেট থেকে বেরোনোর পরই মনির ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। মনির ভাই ওকে বেশ আদর করে। আজও জিজ্ঞেস করলেন “লজেন্স খাবে”? ফাহিম সংকুচিত হয়। হঠাৎই কোন উত্তর খুজে পায় না। কিছু ভাবতে চেষ্টা করে। মনির ফাহিমের হাত ধরে দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। স্কুলটার সামনেই উল্টো দিকে একটা টি স্টল। সেখানে আড্ডা দিচ্ছে ক’জন যুবক। দোকানির ফোম লাগানো চেয়ারে বসে আছে একজন। দলনেতা সোহেল। মানিক, কবির, লিংকন এবার গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। সুমন বয়সে সবার বড়। পড়ালেখা শেষ করেছে। চাকরী বাকরী হয়নি এখনো। গম্ভীর হয়ে থাকে সব সময়। সোহেল পড়ালেখার প ও জানে না। তবু এরা তাকে দলনেতা ভাবতে কুন্ঠিত নয়। সোহেল খুব শ্রদ্ধা করে সুমনকে। এদের এবং আরো অনেকের পড়া শোনায় অবদান আছে সোহেলের। সুমন সোহেলকে জানে। খুব ভালো ভাবেই জানে। ওর অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সব কিছু। অনেক পড়া একটা বইয়ের মতো, মুখস্ত। একটা চাঁপা কষ্ট ছুয়ে যায় সুমনকে। শুধু এতিম বলে কিছুই হতে পারে নি। সোহেল হয়তো ওদের মতোই হতে পারতো। শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত। পরের দুটো যে একদম নেই তা নয়। শুধু শিক্ষাটাই নেই। এই কথাটাও ঠিক হলো না। আসলে পুঁথিগত বিদ্যাটা নেই। ভাবতে থাকে সুমন। “তোরা একটু বস, আমি আইতেছি”। সোহেল দোকান ছাড়ে। সুমনের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সে ও উঠে দাঁড়ায়।
১৭ বছর আগে...
“বড়পা বেডা মাইনসের মুত কি ফেনের লাহান অয়?” সালমা খুব নিবিষ্ট মনে কাঁথায় নকশী আকছিল। বাবা মারা গেছে অনেক বছর। ছোট ভাইটার বয়স মাত্র আড়াই বছর। সে সালমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। সালমা তখন সেভেনে পড়তো। বাবার খুব আদরের ছেলে। মা আর সালমাও খুব আদর করতো। একেবারে যক্ষের ধনের মতো। সংসারে অভাব ছিলো না। খুব সম্পদ না থাকলেও যে সুখী হওয়া যায় তার উদাহরণ। মেয়েতে ছেলেতে তাই বয়সের এ ব্যবধান। সবাই ভেবেছিলো সাজ্জাদের ঐ একটাই মেয়ে। আর ছেলেপুলে হবে না। ওরা কি জানতো সাজ্জাদ নিজেকে সামলে নিচ্ছে? একদিন সাজ্জাদ সাহেব হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেলেন। কোত্থাও নেই। যেন অশরীরি কোন বাহনে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। রাজার গোলাও বসে খেলে শুন্য হয়। সালমাদেরও হলো। তারপর ঘরের দামী জিনিস গুলো একে একে পেটের ভাত হলো। তারও পরে সালমার মা হলেন দর্জি। নকশী কাঁথার কারিগরী মা থেকে মেয়েতে ছড়ালো। বছর খানেক ধরে মাও শয্যাশায়ী। সালমা সারাদিন রাত কাজ করে। ভাইটা মাত্র থ্রিতে পড়ছে। ওর মাথায় এলো না ছোট ভাইটা এ কথা কেন বললো। সে তো কোন পুরুষ মানুষের মুত্র দেখার কথা না! হঠাত সালমা ক্ষেপে যায়। “হারামীর বাচ্চা এইগুলান তুই কি কস? তুই কই দেখলি বেডা মাইনসের মুত?” প্রশ্ন করতে করতে সালমা হারিয়ে যায়। সে পেছনে যায়। যেখানে সে ফেনের মতো কিছু একটা দেখেছে। অনেক বার দেখেছে। হ্যা তার মনে পড়ে।
মান্নান এসে ওর মাকে কাঁথাগুলো দিয়ে যেতো। কাজ শেষ হলে গুনে গুনে কড়ায় গন্ডায় টাকা বুঝিয়ে দিতো। বয়সটা একটু বেশি। এই পঁচিশের মতো হবে। সালমা খেয়াল করতো না আগে। তখনো সে স্কুলে যেতো। মা সেলাই করতেন একাই। তারপর মান্নান কাঁথাগুলো সালমাকে দিতে থাকলেন। টাকাও বুঝে পেতে লাগলো সালমা। মান্নান সে ঘরেরই একজন হয়ে গেলেন। পাওনা এবং না পাওয়ার টাকাও সালমা চাইলে পেত। বয়সের দূরত্ব একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। কিশোরী সালমা মান্নানের সমবয়সী হয়ে গেলো। মায়ের চোখের আড়ালে। কখনো হলে গিয়ে ছবি দেখায়। কখনো নিজেকে বউ ভাবায় উৎফুল্ল হতো। কিশোরী শিহরণে একদিন মান্নানের ফেন দেখেছিল। মান্নান দিয়েছিল ঘর বাধার স্বপ্ন।
হঠাৎ সে বুঝে ওঠে ফেন বেরোবার জোগাড় যন্ত্র। পাগল হয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করে। “লক্ষ্মী ভাই আমার, আমারে ক, তুই কার মুত দেখছস?” এরপর ছোট ভাইটা শুধু বলে গেলো। সালমা শুনলো কি না তা বলার অবকাশ নেই। শুধু সেই বলতে পারবে। “আমি স্কুল থেইকা আইতেছিলাম, মান্নান ভাই আমারে কইল লজেন্স খাবি? আমি কইলাম খামু। তারপর অনেক গুলা লজেন্স কিনলো। বলল আয়। আমি লগে গেলাম। আমারে হের ঘরে নিয়া গেলো। দরজা বন্ধ করলো। ........ কতক্ষণ পরে মান্নান ভাইয়ে ফেনের লাহান মুতলো। হের পরে সবগুলা লজেন্স আমারে দিলো।”
সালমা পলকহীন। ছোট ভাইটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। বিদ্যুত চমকে উঠলো আকাশের কোন এক কোণে। ঝির ঝির করে বাতাস বইলো। তারপর মেঘগুলো ছুটে এলো পৃথিবীর টানে। যে টানে সালমা ছুটেছিল মান্নানের দিকে। সালমা উঠলো। মায়ের ঘরে গেলো। সেখান থেকে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলো। বৃষ্টি পড়ছে। ভাইটা বলল “কই যাও বড়পা?” “মজিদের পাইপের কাছে যাই। মজিদের পানিতে গোসল করমু।” “মজিদের পানিতে গোসল করলে কি অয়?” “পাপ ধুইয়া যায়।” “আমিও গোসল করমু।” “তুইতো কোন পাপ করস নাই। তুই পাপের কিছু তো বুঝসও না।” “আমি তোমার লগে যামু বড়পা।” “না, তুই পাপ করলে হেদিন যাবি।”
[একটা ইচ্ছে ছিল গল্প লিখব শেষ থেকে শুরু করে শুরুতে শেষ, হলো কি না জানি না। চরিত্রগুলো এবং ঘটনা কাল্পনীক হলেও আশে পাশেই ঘটছে এমন ঘটনা, অহরহ]
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক
কি বলব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি সূর্য ভাই ... আসলে ... কষ্ট ...ঘৃণা ...লজ্জা ... এবং ভয় ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারছিনা এই মুহূর্তে ...আপনাকে ধন্যবাদ ও সালাম সমাজের এমন একটি বিষয়ের উপর এই সাহসী গল্পের জন্য ।। -
কি একটা কারণে জানি না আগের মতো একাগ্র হতে পারছি না। সারা মাস যে বিষয়টা নিয়ে ভাবি ঠিক জমা দেয়ার আগে আগে সেটা লেখা হচ্ছে না। হুট করে অন্য একটা থিম চলে আসছে। সম্ভবত আগের মতো তোমাদের পাচ্ছি না বলেই এমনটা হচ্ছে। আর হ্যা তুমি এসেছো খুব খুশী হয়েছি।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।